করোনা ভাইরাসজনিত রোগ (COVID-19) হল সদ্য আবিষ্কৃত এক ধরণের করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক জুনোটিক রোগ। করোনাভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণিকে বোঝায় যেগুলি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদেরকে আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ই জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ১২ ই ডিসেম্বর ২০২০ ইং তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১৬০৩৮৮৬ জন।
COVID-19 ভাইরাস বিভিন্ন লোকের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে থাকে। আক্রান্ত হওয়া বেশিরভাগ মানুষই হালকা থেকে মাঝারি মানের অসুস্থতা অনুভব করবেন এবং হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এটি কীভাবে ছড়ায়
যে ভাইরাসের কারণে COVID-19 হয় তা প্রধানত কোনও সংক্রামিত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা নিঃসরণ থেকে তৈরি হওয়া জলীয় কণার মাধ্যমে সংবাহিত হয়। এই ফোঁটা বাতাসে ভেসে থাকার পক্ষে খুবই ভারী এবং সেই কারণে তা দ্রুত মেঝে বা সারফেসে নেমে আসে।
আপনি COVID-19-এ আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির একেবারে কাছাকাছি থাকলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস গ্রহণের ফলে বা দূষিত কোনও জায়গা স্পর্শ করে তারপর আপনার চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করলে এর দ্বারা সংক্রামিত হতে পারেন।
ভাইরাসটি বিভিন্ন জিনিস বা জায়গার ওপরে কতক্ষন থাকতে পারে
করোনাভাইরাসের বিভিন্ন জিনিসের ওপরে থাকার ব্যপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে যে সাধারন জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করলে, এগুলোকে খুব সহজেই নষ্ট করা যায়। গবেষণায় জানা গেছে যে এই ভাইরাস স্টিল অথবা প্লাস্টিকের ওপর ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত, পেতলের ওপর ৪ ঘন্টা পর্যন্ত এবং কার্ড বোর্ডের ওপর, ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মনে করে, বারে বারে অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড-স্যানিটাইজার দিয়ে অথবা সাবান পানি দিয়ে অবশ্যই হাত ধোবেন l নিজের চোখ, মুখ এবং নাকে হাত দেবেন না ।
আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কী লক্ষণ দেখা যায়
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটতে পারে।
সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গসমূহ:
জ্বর
শুকনো কাশি
ক্লান্তিভাব
কম সাধারণ উপসর্গসমূহ:
ব্যথা ও যন্ত্রণা
গলা ব্যথা
ডায়রিয়া
কনজাংটিভাইটিস
মাথা ব্যথা
স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়া
ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা বা আঙুল বা পায়ের পাতা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
গুরুতর উপসর্গসমূহ:
শ্বাস নিতে অসুবিধা বা প্রবল শ্বাসকষ্ট হওয়া
বুক ব্যথা বা বুকে চাপ অনুভব করা
কথা বলার বা হাঁটাচলার শক্তি হারানো
আপনার গুরুতর উপসর্গগুলি দেখা গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আপনার ডাক্তার বা স্বাস্থ্য পরিষেবার কাছে যাওয়ার আগে থেকে সর্বদা কল করে রাখুন।
হালকা উপসর্গ ছাড়া এমনিতে সুস্থ অনুভব করছে এমন লোকেদের বাড়িতে থেকে তাদের উপসর্গের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কোনও মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে থাকলে, উপসর্গগুলি প্রকাশ পেতে গড়ে 5-6 দিন সময় নেয়, তবে এটি 14 দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
প্রকৃত তথ্য জেনে এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে নিজেকে এবং আপনার চারপাশের মানুষদের সুরক্ষিত রাখুন। আপনার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলুন।
COVID-19-এর সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে:
আপনার হাত প্রায়শই পরিষ্কার করুন। সাবান এবং জল বা অ্যালকোহল রয়েছে এমন হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করুন।
কাশি বা হাঁচি হচ্ছে এমন ব্যক্তির থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
আপনার চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করবেন না।
কাশি বা হাঁচির সময় আপনার নাক এবং মুখটি কনুই ভাঁজ করে বা টিস্যু দিয়ে কভার করুন।
অসুস্থ বোধ করলে বাড়িতেই থাকুন।
জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আগে থেকে কল করে নিলে আপনার স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী দ্রুত আপনাকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যথাযথ সুবিধা দিতে পারবে। এর ফলে আপনি সুরক্ষিত থাকবেন এবং ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করবে।
মাস্ক
মাস্ক ব্যবহার করলে, তা মাস্ক পরা ব্যক্তির থেকে অন্যদের কাছে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। শুধু মাস্ক ব্যবহার করলেই COVID-19-এর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে না এবং তার পাশাপাশি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং হাত ধুতে হবে। আপনার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত পরামর্শ মেনে চলুন।
এখনও অবধি, COVID-19-এর জন্য কোনও নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসন্ধানের পর্যায়ে রয়েছে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে পরীক্ষিত হবে-- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
নিজের যত্ন ঃ
অসুস্থ বোধ করলে আপনার বিশ্রাম নেওয়া, প্রচুর পরিমাণে জল ও সরবত পান করা এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদা ঘরে থাকুন এবং সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট বাথরুম ব্যবহার করুন। প্রায়শই স্পর্শ করছেন এমন জায়গাগুলি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করুন।
বাড়িতে প্রত্যেকেরই সুস্থ জীবনযাত্রা বজায় রাখা উচিত। স্বাস্থ্যকর ডায়েট বজায় রাখুন, ঘুমান, সক্রিয় থাকুন এবং প্রিয়জনের সাথে ফোন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন। সঙ্কটের সময় বাচ্চাদের বড়দের অতিরিক্ত ভালবাসা এবং মনোযোগ প্রয়োজন। যথাসম্ভব নিয়মিত রুটিন এবং সময়সূচি বজায় রাখুন।
কোনও সঙ্কটের সময় দুঃখ হওয়া, মানসিক চাপ অনুভব করা বা বিভ্রান্ত বোধ করা স্বাভাবিক। বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের মতো আপনি আস্থা রাখেন এমন মানুষদের সাথে কথা বললে ভালো লাগতে পারে। আচ্ছন্ন বোধ করে থাকলে কোনও স্বাস্থ্যকর্মী বা কাউন্সেলরের সাথে কথা বলুন।
চিকিৎসা ঃ
আপনি হালকা উপসর্গ ছাড়া এমনিতে সুস্থ অনুভব করে থাকলে সেল্ফ আইসোলেট থাকুন এবং পরামর্শের জন্য আপনার ডাক্তারের সাথে বা কোনও COVID-19 তথ্যের লাইনে যোগাযোগ করুন।
আপনার জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আগে থেকে কল করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন।
কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেসন কি
কোয়ারেন্টাইনঃ কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে সেই সকল সুস্থ ব্যক্তিদের (যারা কোন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছে) অন্য সুস্থ ব্যক্তি থেকে আলাদা রাখা হয়, তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং তারা এ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
আইসোলেশনঃ আইসোলেশন এর মাধ্যমে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের অন্য সুস্থ ব্যক্তি হতে আলাদা রাখা হয়।
পার্থক্যঃ
কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছে এমন সুস্থ ব্যক্তিদের আলাদা রাখা হয় ও তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয় অপরপক্ষে আইসোলেশন এর মাধ্যমে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের আলাদা রাখা হয়।
কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণাধীন সুস্থ ব্যক্তিবর্গ এ নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় কিনা তা দেখা হয় আর আইসোলেশন এর মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তি হতে যেন সুস্থ ব্যক্তিরা আক্রান্ত না হয় সে জন্য অসুস্থ ব্যক্তিদের অন্য সুস্থ ব্যক্তি হতে আলাদা রাখা হয়।
করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ভুল ধারণাগুলো কী কী
করোনা ভাইরাস নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে l আসুন সঠিক তথ্যগুলো জেনে নেই l - যে কোনো বয়সী মানুষের করোনাভাইরাস সংক্রমণ/ কোভিড-১৯ রোগ হতে পারে। তবে বয়স্ক মানুষ এবং যাঁদের হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের সমস্যা আছে তাঁদের এই ভাইরাসে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হচ্ছে - ঠাণ্ডা বা গরম আবহাওয়া, আর্দ্র জলবায়ু ইত্যাদির সাথে এই ভাইরাস এর কমা-বাড়ার কোনো সম্পর্ক নাই - করোনাভাইরাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে না - পোষা প্রাণী, যেমন কুকুর বা বিড়াল করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে এমন তথ্য বা প্রমান নেই - নিয়মিত গরম পানিতে গোসল করলে করোনাভাইরাস হবে না এটা সঠিক নয় - হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে করোনাভাইরাস মারা যায় না - জীবাণু মুক্ত করার জন্য অতি বেগুনি (আল্ট্রাভায়োলেট) রশ্মি ব্যবহার করা উচিত নয়।এতে চামড়া জ্বালা করতে পারে - থার্মাল স্ক্যানারগুলি শুধু জ্বর পরীক্ষার জন্য, কোভিড-১৯পরীক্ষার জন্য নয় - শরীরে থাকা ভাইরাস মারার জন্য শরীরে এলকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করলে লাভ নাই - নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (এইচ আই বি) ভ্যাকসিন কাজ করলেও, করোনাভাইরাস এর বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন কাজ করে না - রোজ স্যালাইন দিয়ে নাক ধুলে করোনো ভাইরাস ছড়াবে না - এ তথ্যের কোনো কোনো ভিত্তি নেই - রসুন স্বাস্থ্যকর, তবে রসুন খেলে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে এর কোনো প্রমান নেই l




Post a Comment